পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১৭)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৫:১২:৩৯ বিকাল
মিথিলা!
সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার চাপ খানিকটা বাড়ল। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে রেজাল্ট খুব একটা ভালো হল না। বাবার তখন অফিসে কী নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। মা আমার রেজাল্ট শুনে কিছু বলতে চেয়েও বললেন না। আমার কেন যেন মনে হল, মা'র চোখে পানি ছিল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। রেজাল্ট দেখে লাভলিও মন খারাপ করল। ওর রেজাল্ট আমার চেয়ে ভালো হয়েছিল। খুব অল্প ছেলেমেয়ে পাস করল। আমরা দু'জন সেই অল্পদের মধ্যে রইলাম। আমার এস এস সি'র রেজাল্টের সাথে তুলনা করে স্বজনেরা, পরিচিতেরা দু:খ করলেন। আমি দু:খ করলাম না, দু:খ তৈরী করেছি বলে বিস্বাদ মনে মহল্লার ফুটবল মাঠের কিনারায় গিয়ে একা বসে রইলাম। ততদিনে সিগারেটের বদভ্যাস রপ্ত করেছি। আমার ভিতরে আলোর পাশে কালো এসে জমা হয়েছে অনেক।
রেজাল্টের পর লাভলির সাথে কথাবার্তা আরো কমে গেল। ও লেখাপড়ায় মন দিল। প্রতিদিন ক্লাসে ওর পারফর্মেন্স দ্রুত ভালো হতে শুরু করল। আমি নিয়মিত পিছনের বেঞ্চে একা বসে ঝিমাতে থাকলাম। মাঝে মাঝেই ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে সেখানে ভবঘুরের মত ঘুরতে শুরু করলাম। বুকের ভিতরে অচেনা জ্বালা। কোথায় গেলে শান্তি পাব জানি না।
সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরুর মাস খানেক পর লাভলি একদিন ক্লাসশেষে ক্লাসের পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওকে দেখে সামনের দরজা দিয়ে বের হলাম। লাভলি ডাকল। করিডোর খালি। শুধু ও আর আমি। এই ডাক উপেক্ষা করা কঠিন। দাঁড়ালাম। ওকে একটু এলোমেলো দেখাচ্ছিল। মুখ মলিন। মনে মনে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেমন আছ? ' মনে হল ও আমার প্রশ্নটারই উত্তর দিল, 'আমার মনটা ভাল না। ' আমি দেখলাম ওর শরীরটা ও ভালো না। কিন্তু কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। অপেক্ষা করছিলাম। ও বলুক। ও ক্লান্ত কিন্তু জেদী গলায় বলল, 'বৃহস্পতিবার ক্লাস করবো না। আমাদের কথা হওয়া দরকার।'
ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। বললাম, 'বলো'
বলল, 'এখানে না। এখন না'
জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায়? কখন?'
বলল,'তুমি ঠিক কর।'
আমার মনে হচ্ছিল শিকলে বাধা বিদ্রোহী! মুক্তি চাই!
শান্ত গলায় বললাম,
' রুপসার পাড়ে? রুজভেল্ট জেটির কাছে। আসতে পারবে? '
প্রশ্নটা শুনে ওর মুখে হাসি ফুটল। ও হাসলে মুখটা আলো হয়ে যায়। আমিও হাসলাম।
মনে হল,আমাকে হাসলে কেমন দেখায়, ও জানে? জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ও একেবারে হাসিতে ভেংগে পড়ল। আমার মন ভালো হয়ে গেল। অনেক হালকা লাগছিল। কথা হল, ও মিনাসহ আসবে। মিনার সাথে ফিরোজ ভাই আসবে। আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছেন। নদী দেখবেন।
তিনজন একসাথে ক্লাস ফাঁকি দিলাম। ফিরোজ ভাইয়ের সাথে উনার একজন ক্লাসমেট এলো। নদীতে বেড়ালাম। মিনা ওদের দু'জনকে নিয়ে এক নৌকায় উঠল। আমরা অন্য নৌকায়। নদীর পাশে গেলে সব কথা নিরব হয়ে যায়। লাভলিকে খুব সুখী দেখাচ্ছিল। ও নানান কথা বলছিল। আমি ভাবছিলাম ও কী কথা বলার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে। তার আর আমার হৃদয়ের কথাগুলো নদীর পানিতে বৈঠার শব্দে, পাখির ডাকে, মাঝির কথায় একাকার হয়ে গেল। মুখে যা বলছিলাম তা নয়, আমরা আসলে অন্য কিছু বলছিলাম। একে অন্যের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য প্রাণ কাঁদছিল। খোলা আকাশের নীলে, সাদায়, গাছের পাতার দোলে, পাখির উড়ে যাওয়ায়, নৌকার গতিতে যে প্রাণ ছিল তার সাথে ও আমরা মিশে যেতে চাচ্ছিলাম। প্রাণটা ভরে সুখ নিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা বিয়ে করেছি! ওকে বললাম। শুনে ও মৃদু হাসল। সেই হাসিটাতে অনেক কথা, অনেক অনুভুতি একসাথে দেখলাম। মাঝিও হাসল। খুশির হাসি। বলল,'আপনাগের বিয়েতি আমারে দাওয়াত দেবেন নে '
বললাম, দেবো।
মাঝি আমার আব্বাকে চিনত। লাভলির বাবাকেও। লাভলি হেসে জিজ্ঞেস করল,' ঘটকালি করবেন? '
মাঝি হাসল,'করমু আনে '
সেই কয়েকটা ঘন্টা খুব ভালো কাটল আমাদের।
আমার পড়ায় মন বসল। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। পরীক্ষা সামনে। বাবা, মা, লাভলি, আত্মীয় প্রতিবেশী, বন্ধুদের মলিন চেহারা কল্পনায় দেখে নিজেকে সতর্ক করলাম। ক্লাসে নিয়মিত হলাম। লাভলি আমার সাথে ছায়ার মত হয়ে গেল। কাছে দূরে যেখানে যেভাবেই থাকি দু'জন দু'জনকে অনুভবে নিয়ে ফিরি। সংসার না হলেও আমাদের এক রকম সংসার হল মনে মনে। নিত্যিদিন লেনদেন চলতে থাকল। শুধু দু'জনেই সতর্ক রইলাম। মিনার মা'র কথাগুলি আমাদের মনে রইল। নির্জনে দু'জন আর দেখা করলাম না। তবু মন ভরা সুখ রইল। বরং নিষ্পাপ থাকার আনন্দটা সব আনন্দের চেয়ে বেশি হল। সামনের উজ্জ্বল দিনের ভাবনায় ডুবে রইলাম। একদিন হিসাব করে দেখলাম কলেজ, প্রাইভেট পড়া, ঘরের পড়া মিলে প্রায় বারো ঘন্টাই পড়ার মধ্যে আছি। সাব্জেক্ট গুলি নিজেরা নোট করতে লাগলাম। বই ঘেটে আরো ইনফর্মেশন, আরো সুন্দর ভাষা, হাতের লেখা, লেখার দ্রুততা -নানান খুঁটিনাটি দিকে নজর দিতে শুরু করলাম।
পড়ায় মন দিতে দেখে মা খুব খুশি হলেন। মা'কে পালকের মত লাগত। একবার দুধের গ্লাস হাতে, একবার গরম কোন ভাজাভুজি হাতে, এক একবার এমনিতেই আমার রুমে আসতে থাকলেন। মাঝে মাঝে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন। কোনদিন আবার ঠেলে চেয়ার থেকে তুলে দিতেন, 'এত বেশিক্ষণ এক নাগাড়ে বসে থাকলে ভালো না। গলির মাথা থেকে ঘুরে আস। কোনদিন বলতেন, চুল কেটে আস। বাদলের সাথে দেখা সাক্ষাৎ একেবারে কমে গেল। ও যে কোথায় কোথায় থাকে তাও জানি না। দিন দ্রুত যাচ্ছিল।
একবেলার সিগারেট ছাড়তে পারলাম না। রাতে খাওয়ার পর পাশের গলিতে মুদির দোকানে আসা যাওয়া নিয়মিত রইল। আর লাভলিদের বাসার পাশ দিয়ে আসা যাওয়ার সময় অদ্ভুত একটা অনুভুতির উপস্থিতি নিয়মিতই পেতে থাকলাম। কোন কোনদিন জানালায় লাভলিকে দেখতাম। আরামের একটা বোধ সমস্ত শরীর দিয়ে মনে আসত।
জীবনে স্থিতি টের পেলাম।
আমার বাবু!
সেদিন সকাল থেকে খুব ঘুম পাচ্ছিল। সকালে পড়ে বাসায় এসে আর পড়তে ইচ্ছে করল না। চাঁপা বিলুর মা'র সাথে কথা বলছিল। আমার 'খই ফোটা' বাগধারাটা মনে পড়ল। চাঁপার নাম মিনি রাখলে ঠিক হত। ও 'কাবুলিওয়ালা'র মিনির মত সারাদিন কারো না কারো সাথে কিচির মিচির করতেই থাকত। এক একদিন আমার রুমে এসে বইখাতা টানাটানি করত। বলত, ' এক একদিন আমার রুমে এসে বইখাতা টানাটানি করত। সেদিন এসে বলল, ' এত বড়.....' বলেই এক দৌড়ে ওর ভেজিটেবল আর মাছের ছবির বইগুলি নিয়ে এলো। ওর তখনো কথা স্পষ্ট না। পড়ার বয়স তো মোটেই না। কিন্তু ঘরের সবাইকে পড়তে দেখে পড়ার জন্য বায়না ধরেছে। সেই কারণে ওর এখন পাঁচটা বই। সবই ছবির বই।
ওর হাতের বই দেখে আমি হাসলাম, ' আমিতো বড়। আমার বই ও সেইজন্য বড়। '
স্বীকার করতে হল, ওর বই গুলি আমার বইয়ের চেয়ে সুন্দর। ওর বইয়ের ছবিগুলি সুন্দর। এত লেখা নেই। বড় বড় লেখা পড়তে সহজ। বিলুর মা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল। চাঁপা ওকে দেখিয়ে বলল, 'ও পড়ে না। বিলু ও পড়ে না।'
বিলুর মা বলল, 'আমার তো বই নাই। পড়বানে কি কইরে?'
চাঁপা গম্ভীর হয়ে বলল, 'তুমিত বড়, তুমি ছোট বই পড়তে পারবে নানে, তুমি ছোট হইলে তখন তুমারে ছোট বই দেবানে। ' বিলুর মা, বিলু, আম্মা সবাই শব্দ করে হেসে ফেলল। চাঁপা ওকে নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে দেখে রেগে কেঁদে আমার কোলে এসে বসল,'ওগেরে বকে দাও বড় ভাইয়া, ওরা ভাল না! '
বিলুর মা হাসতে হাসতেই চাঁপাকে সতর্ক করল। 'তুমি আমার মত করে কথা ক'লে তুমার আব্বা আমারে বকপে কিন্তক'..
চাঁপা বিলুর মা'র দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে ফ্রকের কুচি ঠিক করে আমার কোলে আরো ভালো করে বসল। নির্ভরতা! আমি ওর সিল্কের মত চুলগুলি ধরে আদর করে দিলাম।ঘরের সবার চোখের মণির মতই ছিল ও। ওকে নিয়ে আমার হঠাৎ বাইরে ঘুরতে ইচ্ছে হল। মা'কে বলে ওকে কোলে নিয়ে বের হলাম।
কেবল গেট থেকে বের হয়েছি, আমাদের গেটে একটা মাইক্রো এসে থামল। মাইক্রোর দরজা খুলে পর পর দু'জন লোক নামল। দু'জন মিলে গাড়ির ভিতর থেকে সাবধানে কাউকে নামাল। দেখলাম আব্বা!
চাঁপাকে ধরা হাত বোধহয় আলগা হয়ে গিয়েছিল, ও আমার গলায় দুই হাত বেড় দিয়ে ঝুলে গেল। আমি তড়াতাড়ি ওকে কোল থেকে গেটের ভিতরে নামিয়ে দিয়ে আব্বাকে ধরলাম। দুইজনের কাধে ওজন ছেড়ে বাবা তাকিয়ে আছেন, কিছু বলছেন না। আমার বুকে জোরে আওয়াজ দিয়ে এলোপাথাড়ি বাড়ি দিচ্ছিল হার্ট। লোকগুলিকে জিজ্ঞেস করলাম,' কী হয়েছে!'
নিজের গলা নিজেই চিনলাম না। লোকগুলি বলল,'সিরিয়াস কিছু না, একটু বিশ্রাম লাগবে।'
ওদের একজন আমার জন্য জায়গা ছেড়ে দিল। আমি বাবার হাতের নিচে হাত গলিয়ে ওপাশের কাঁধ জড়িয়ে ধরলাম। গেটটা পুরোটা খুলে দেয়া হল। আমি বাবাকে নিয়ে গেট পার হয়ে ঢুকার মুখে দেখলাম বারান্দায় আম্মা! কোন মানুষের এমন মুখ আমি আর আগে কখনো দেখিনি। মা'র চেহারায় ভয়, দুশ্চিন্তা, ভালোবাসা, কঠোরতা, রাগ সবকিছুই আলাদা আলাদা করে দেখা গেল এক মুহুর্তের মধ্যে!
বিকালে ঘুম থেকে উঠে আব্বা স্বাভাবিক স্বরে চা চাইবার পর সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল।
বাবা কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেন।
আমি অনেক কিছু ভাবলাম। আব্বাকে হারাতে পারতাম! যদি আব্বার কিছু হয়, আমি বাড়ির বড় ছেলে, এই সংসারের দায়িত্ব আমার! মা দুর্বল। বাদল, চাঁপা ছোট। আমাদের এই বাড়িটা ছাড়া রোজগার কেবল আব্বারই! দাদীর কথা মনে পড়ল। গ্রামের কথা মনে পড়ল। ওখানে আমাদের কিছু সম্পত্তি আছে। দখল নাই। ওখানে আমাদের কিছু মানুষ আছে, আত্মীয়তা আছে, আমাদের আত্মার সাথে তাদের আত্মার কোন বাঁধন নাই। টান নাই।
আমার লাভলির কথা মনে হল। চাঁপাকে নিয়ে বের হওয়ার সময় তখন ভাবছিলাম, আমার আর লাভলির বিয়ে হলে চাঁপার মত ফুটফুটে একটা মেয়ে হতে পারে। পরে মনে হল, আমাদের যদি সত্যিই কোন বিপর্যয় হয়ে যায়, লাভলি কি সম্পর্কটা রাখবে? আমি যদি খুব বড় কেউ হতে না পারি, ও কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবে?
মন বলল, করবে।
আব্বার অসুস্থতার খবরটা লাভলিকে দেয়ার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল। সন্ধ্যার পর আম্মাকে বললাম, বন্ধুর বাসায় যেতে হচ্ছে। মা গলার আওয়াজ ছোট করে ললেন,'তোমার আব্বা তোমাকে খুঁজতে পারে। দেরী করবা না।'
আমি আরিফুলের বাসার দিকে রওনা দিলাম। যেতে যেতে পথের পাশের একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনতে গিয়ে একটা কথা মনে হল। টাকাটা আব্বা কষ্ট করে রোজগার করেন। আমি সিগারেটটা হাত থেকে দোকানের ক্যাশবক্সের উপর নামিয়ে রাখলাম।
বললাম, ' থাক। লাগবে না।'
রাস্তার পাশের সারিবাঁধা দোকানের আলোয় পথ চলতে চলতে ভাবতে লাগলাম, 'জীবন কত অনিশ্চিত! '
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০৩৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ভালো থাকবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন